কী হচ্ছে আলমাতি শহরে?

  • আপডেট সময় : ০৪:৩৩:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২২
  • / 503
প্রবাসী কণ্ঠ অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় শহর আলমাতি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে দেশটিতে ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই শহরটি।

 

 

অন্তত ছয় দিন ধরে চলা বিক্ষোভ-দাঙ্গায় দেশটিতে নিহতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেছে। বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট।

শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) সেই আলমাতি শহর ঘুরে দেখেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদক আবুজলিল আব্দুরাসুলফ। তার সেই অভিজ্ঞতা নিচে তুলে ধরা হলো:

ভোরবেলা এই শহরের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেল পোড়া টায়ারের গন্ধে ভারি হয়ে আছে আকাশ-বাতাস। রাস্তায় লোকজন খুবই কম। অনেকেই বাড়ির বাইরে বেরোতে সাহস পাচ্ছেন না।

শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো ছিল গণবিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে এখন সেনা ও পুলিশের রোডব্লক।

আমরা যখন আলমাতি শহরের প্রধান স্কয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখানে সৈন্যরা চিৎকার করে আমাদের কাছে যেতে বারণ করল এবং আকাশে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ল।

আমি বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়মিতভাবে আলমাতি গিয়েছি। স্বাভাবিক অবস্থায় এই বিশাল শহরটি থাকে কর্মচঞ্চল। প্রচুর সবুজ জায়গা রয়েছে শহরে। রয়েছে খানা-পিনার অঢেল ব্যবস্থা। কিন্তু আলমাতির বহু দোকান-পাট আর ব্যাংক এখন বন্ধ। সেগুলোতে লুটতরাজ হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে।

আলমাতিতে বেশিরভাগ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রধান স্কয়ারের আশেপাশে। বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর এখানেই প্রতিবাদকারীরা প্রথম জড়ো হয়। এ সময় আশেপাশের সংবাদমাধ্যমগুলোর অফিস হামলার শিকার হয় এবং মেয়রের অফিস পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়।

ভবনটির রং এখন কালো। এখনো সেখান থেকে কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা গেল। কিছু লোককে দেখা গেল মোবাইল ফেনের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে।

এখানকার কয়েকজন বাসিন্দা জানালেন, তারা হতবাক আর ক্ষুব্ধ। কাজাখস্তানে এ ধরনের সহিংস বিক্ষোভ এক বিরল ঘটনা। যে দ্রুততার সঙ্গে এই সহিংসতা ছড়িয়েছে তাতে তারা অবাক হয়ে গেছেন।

কয়েকজন বলেন, রাশিয়া ও অন্য দেশ থেকে সৈন্য আসাতে তারা খুশি হয়েছেন। তারা আশা করছেন, এতে হয়তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

একজন নারী বলেন, সরকারের উচিত ছিল একেবারে গোড়া থেকেই কঠোর হাতে এসব দমন করা। শুরু থেকে বল প্রয়োগ করলে এসব ঘটতো না। সম্ভবত অস্ত্র ব্যবহারের জন্য তারা নিন্দার ভয়ে চিন্তিত ছিল। কিন্তু দেখুন এখন কী হাল।

সহিংসতা নিয়ে রাগ থাকলেও প্রতিবাদকারীদের প্রতিও রয়েছে কিছু মানুষের সহানুভূতি। এসব বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন এমন অনেক মানুষ এসেছিলেন গ্রামাঞ্চল থেকে। তাদের আয় কম এবং সংসার চালাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।

২২ বছরের একজন পাচক বলেন, বিক্ষোভকারীদের দাবিগুলোর মধ্যে তাদের বেতন বাড়ছে না, জনগণের বেশিরভাগই বহু কষ্টে জীবনযাপন করছেন। কিন্তু এখনকার ভাঙচুর আর গুণ্ডামিতেও সাধারণ মানুষই কষ্ট পাচ্ছে। এসব বন্ধ হওয়া দরকার।

 

আলমাতির বাসিন্দাদের সামনে রয়েছে খাদ্য সঙ্কট। সুপার মার্কেটগুলো এখন বন্ধ। যেসব দোকান খোলা তারা শুধু নগদ অর্থে বেচাকেনা করে। এটিএম থেকে টাকা তোলা বেশ কঠিন। শহরে কোনো ইন্টারনেট সংযোগ নেই। এমনকি রাস্তায় ট্যাক্সি পাওয়াও কঠিন।

ইন্টারনেট আর ফোন না থাকার কারণে দেশের অন্য জায়গায় কী ঘটছে তা জানাও কঠিন। এত গুজব বাতাস উড়ছে যে, কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা তা যাচাই করা কঠিন।

কাজাখস্তানে আগে যেসব বিক্ষোভ হয়েছে, তার সবাই মূলত ছিল স্থানীয় পর্যায়ে। এর কোনোটিতেই বিমানবন্দরের ওপর কোনো হামলা হয়নি। সম্প্রতি এই বিক্ষোভ শুরু হয় জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে ছিল ব্যাপক অসন্তোষ।

কাজাখস্তানের স্বাধীনতার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নজরবায়েফ দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেন। ২০১৯ সালে তার পদত্যাগের পর কাজাখরা আশা করেছিলেন যে, নতুন প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ দেশে বড় ধরনরে পরিবর্তন আনবেন।

কিন্তু তারা আশাহত হন। এর মধ্যে একটি ঘটনায় রাজধানী আস্তানার নতুন নামকরণ করা হয় নুর-সুলতান। এই ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, আগের সরকারের লোকজনের হাতেই ক্ষমতা রয়ে গেছে।

এখন কাজাখস্তানের পরিস্থিতি বেশ শান্ত এবং দেশের নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যত সরকারের হাতে। কিন্তু বিক্ষোভ আপাতত থামলেও অসন্তোষ রয়েই গেছে। ফলে যে কোনো স্ফুলিঙ্গ থেকে আবার বিক্ষোভে আগুন ধরে যেতে পারে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

কী হচ্ছে আলমাতি শহরে?

আপডেট সময় : ০৪:৩৩:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২২

মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় শহর আলমাতি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে দেশটিতে ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই শহরটি।

 

 

অন্তত ছয় দিন ধরে চলা বিক্ষোভ-দাঙ্গায় দেশটিতে নিহতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেছে। বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট।

শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) সেই আলমাতি শহর ঘুরে দেখেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদক আবুজলিল আব্দুরাসুলফ। তার সেই অভিজ্ঞতা নিচে তুলে ধরা হলো:

ভোরবেলা এই শহরের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেল পোড়া টায়ারের গন্ধে ভারি হয়ে আছে আকাশ-বাতাস। রাস্তায় লোকজন খুবই কম। অনেকেই বাড়ির বাইরে বেরোতে সাহস পাচ্ছেন না।

শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো ছিল গণবিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে এখন সেনা ও পুলিশের রোডব্লক।

আমরা যখন আলমাতি শহরের প্রধান স্কয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখানে সৈন্যরা চিৎকার করে আমাদের কাছে যেতে বারণ করল এবং আকাশে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ল।

আমি বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়মিতভাবে আলমাতি গিয়েছি। স্বাভাবিক অবস্থায় এই বিশাল শহরটি থাকে কর্মচঞ্চল। প্রচুর সবুজ জায়গা রয়েছে শহরে। রয়েছে খানা-পিনার অঢেল ব্যবস্থা। কিন্তু আলমাতির বহু দোকান-পাট আর ব্যাংক এখন বন্ধ। সেগুলোতে লুটতরাজ হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে।

আলমাতিতে বেশিরভাগ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রধান স্কয়ারের আশেপাশে। বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর এখানেই প্রতিবাদকারীরা প্রথম জড়ো হয়। এ সময় আশেপাশের সংবাদমাধ্যমগুলোর অফিস হামলার শিকার হয় এবং মেয়রের অফিস পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়।

ভবনটির রং এখন কালো। এখনো সেখান থেকে কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা গেল। কিছু লোককে দেখা গেল মোবাইল ফেনের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে।

এখানকার কয়েকজন বাসিন্দা জানালেন, তারা হতবাক আর ক্ষুব্ধ। কাজাখস্তানে এ ধরনের সহিংস বিক্ষোভ এক বিরল ঘটনা। যে দ্রুততার সঙ্গে এই সহিংসতা ছড়িয়েছে তাতে তারা অবাক হয়ে গেছেন।

কয়েকজন বলেন, রাশিয়া ও অন্য দেশ থেকে সৈন্য আসাতে তারা খুশি হয়েছেন। তারা আশা করছেন, এতে হয়তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

একজন নারী বলেন, সরকারের উচিত ছিল একেবারে গোড়া থেকেই কঠোর হাতে এসব দমন করা। শুরু থেকে বল প্রয়োগ করলে এসব ঘটতো না। সম্ভবত অস্ত্র ব্যবহারের জন্য তারা নিন্দার ভয়ে চিন্তিত ছিল। কিন্তু দেখুন এখন কী হাল।

সহিংসতা নিয়ে রাগ থাকলেও প্রতিবাদকারীদের প্রতিও রয়েছে কিছু মানুষের সহানুভূতি। এসব বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন এমন অনেক মানুষ এসেছিলেন গ্রামাঞ্চল থেকে। তাদের আয় কম এবং সংসার চালাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।

২২ বছরের একজন পাচক বলেন, বিক্ষোভকারীদের দাবিগুলোর মধ্যে তাদের বেতন বাড়ছে না, জনগণের বেশিরভাগই বহু কষ্টে জীবনযাপন করছেন। কিন্তু এখনকার ভাঙচুর আর গুণ্ডামিতেও সাধারণ মানুষই কষ্ট পাচ্ছে। এসব বন্ধ হওয়া দরকার।

 

আলমাতির বাসিন্দাদের সামনে রয়েছে খাদ্য সঙ্কট। সুপার মার্কেটগুলো এখন বন্ধ। যেসব দোকান খোলা তারা শুধু নগদ অর্থে বেচাকেনা করে। এটিএম থেকে টাকা তোলা বেশ কঠিন। শহরে কোনো ইন্টারনেট সংযোগ নেই। এমনকি রাস্তায় ট্যাক্সি পাওয়াও কঠিন।

ইন্টারনেট আর ফোন না থাকার কারণে দেশের অন্য জায়গায় কী ঘটছে তা জানাও কঠিন। এত গুজব বাতাস উড়ছে যে, কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা তা যাচাই করা কঠিন।

কাজাখস্তানে আগে যেসব বিক্ষোভ হয়েছে, তার সবাই মূলত ছিল স্থানীয় পর্যায়ে। এর কোনোটিতেই বিমানবন্দরের ওপর কোনো হামলা হয়নি। সম্প্রতি এই বিক্ষোভ শুরু হয় জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে ছিল ব্যাপক অসন্তোষ।

কাজাখস্তানের স্বাধীনতার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নজরবায়েফ দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেন। ২০১৯ সালে তার পদত্যাগের পর কাজাখরা আশা করেছিলেন যে, নতুন প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ দেশে বড় ধরনরে পরিবর্তন আনবেন।

কিন্তু তারা আশাহত হন। এর মধ্যে একটি ঘটনায় রাজধানী আস্তানার নতুন নামকরণ করা হয় নুর-সুলতান। এই ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, আগের সরকারের লোকজনের হাতেই ক্ষমতা রয়ে গেছে।

এখন কাজাখস্তানের পরিস্থিতি বেশ শান্ত এবং দেশের নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যত সরকারের হাতে। কিন্তু বিক্ষোভ আপাতত থামলেও অসন্তোষ রয়েই গেছে। ফলে যে কোনো স্ফুলিঙ্গ থেকে আবার বিক্ষোভে আগুন ধরে যেতে পারে।