কাছে থেকেও দূরের ভাড়া ঢাকা-বরিশাল বিমানে
- আপডেট সময় : ০৫:২৬:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২
- / 255
পদ্মা সেতুর কল্যাণে সারা দেশের মানুষ এখন দেখছে রাজধানী ঢাকা থেকে কত কাছে বিভাগীয় শহর বরিশাল। অথচ কাছের এই বরিশালেই আকাশপথে যাতায়াত প্রশ্নে বহু বছর ধরে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া দিতে হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে।
দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণে বৈষম্যের কারণে সৃষ্টি হয়েছে এই পরিস্থিতির। রাজধানী থেকে সবচেয়ে কাছের গন্তব্য হওয়া সত্ত্বেও দেশের অন্যান্য রুটের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া দিয়ে বিমানে উঠতে হয় বরিশালের যাত্রীদের।
জানুয়ারি থেকে চলছে এই অবস্থা। বিষয়টি নিয়ে যাত্রীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি মার্চে বরিশালে আসা বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। বরঞ্চ বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নির্ধারিত ভাড়া আখ্যা দিয়ে যখন-তখন তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এ রুটে চলাচলকারী সরকারি-বেসরকারি বিমান। ফলে অতিরিক্ত ভাড়ায় আকাশপথে ঢাকা যেতে বাধ্য হচ্ছেন বরিশালের যাত্রীরা।
দেশের অভ্যন্তরে যে কটি রুটে রাজধানী ঢাকা থেকে বিমান চলাচল করে তার মধ্যে সবচেয়ে স্বল্প দৈর্ঘ্যরে রুট হচ্ছে ঢাকা-বরিশাল। দৈনিক গড়ে ৪টি ফ্লাইট পরিচালিত হওয়া এ রুটের দূরত্ব মাত্র ৬১ অ্যারোনটিক্যাল মাইল। দ্বিত্বীয় স্বল্প দৈর্ঘ্যরে রুট ঢাকা-যশোরের দূরত্ব ৭৯ অ্যারোনটিক্যাল মাইলের কিছু বেশি। অথচ এই দুই রটের যাত্রীদের বিমানে ওঠা প্রশ্নে গুনতে হয় ঢাকা থেকে ১৪৬ অ্যারোনটিক্যাল মাইল দূরত্বে থাকা সৈয়দপুর রুটের সমান ভাড়া। ডিসেম্বরে ঢাকায় বেবিচক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সমন্বয় সভার পর থেকেই চলছে এ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়। অথচ আকাশপথের দূরত্বের বিচারে ভাড়া অনেক কম হওয়ার কথা ঢাকা-বরিশাল রুটে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিমানের ভাড়া নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা ‘প্রাইসিং বিভাগ’র এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘গত বছরের শেষের দিকে বেবিচকের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিমান সংস্থার সমন্বয় সভা হয়। সেখানে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানের ভাড়া নিয়ে আলোচনা হলে একাধিক বিমান সংস্থা অভিযোগ করে যে, প্রতিযোগিতার নামে কেউ কেউ অনেক কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণ করছে। এতে করে লোকসানের মুখে পড়ছে একাধিক বিমান কোম্পানি। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে যাত্রী ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানান তারা। সভায় সবার সঙ্গে আলোচনা করে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে বিমান চলাচল প্রশ্নে সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৩ হাজার ২শ টাকা। এর সঙ্গে ভ্যাটসহ আনুষঙ্গিক যোগ করে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৩ হাজার। বর্তমানে এই হারেই চলছে বিভিন্ন রুটে সরকারি-বেসরকারি বিমানের ভাড়া আদায়।’
সমন্বয় সভার ওই সিদ্ধান্তে দেশের অন্যান্য রুটের বিমানযাত্রীরা লাভবান হলেও বিপাকে পড়েছেন ঢাকা-বরিশাল রুটের যাত্রীরা। কেননা গড় হিসাবে বিমান সংস্থাগুলো যেভাবে ভাড়া আদায় করছে তাতে প্রায় সব রুটেই ভাড়ার অঙ্ক থাকছে কাছাকাছি। ফলে দূরত্বের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে ঢাকা-বরিশাল রুটের যাত্রীদের। বিভিন্ন বিমান সংস্থার ওয়েবসাইট অনুযায়ী গত এক সপ্তাহ ধরে ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সৈয়দপুরসহ প্রায় সব রুটে এক পথের বিমান ভাড়া দেখানো হয়েছে গড়ে ৩ হাজার ৬শ থেকে সাড়ে ৪ হাজার পর্যন্ত। ঢাকা-বরিশালের ক্ষেত্রেও চাওয়া হয়েছে একই ভাড়া। ঢাকা থেকে ১৪৬ অ্যারোনটিক্যাল মাইল দূরে থাকা সৈয়দপুরের ভাড়া ছিল ৩ হাজার ৬শ থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে। এই হিসাবে ঢাকা-সৈয়দপুর রুটে প্রতি অ্যারোনটিক্যাল মাইলে যেখানে ভাড়া দাঁড়ায় ২৩ টাকা ৯৭ পয়সা সেখানে ঢাকা-বরিশাল রুটে আদায় করা হয় প্রতি অ্যারোনটিক্যাল মাইলে ৬৫ টাকা ৫৭ পয়সা।
শুধু এ একটি রুটই নয়, অভ্যন্তরীণ সব রুটের ক্ষেত্রেই এভাবে তুলনামূলক দ্বিগুণ এমনকি আড়াইগুণ পর্যন্ত বেশি ভাড়া দিয়ে বিমানে উঠতে হচ্ছে বরিশালের যাত্রীদের। ঢাকা-বরিশাল রুটে প্রতি অ্যারোনটিক্যাল মাইলে প্রায় ৬৬ টাকা ভাড়ার বিপরীতে ঢাকা থেকে ১৭২ অ্যারোনটিক্যাল মাইল দূরে থাকা কক্সবাজার রুটে ভাড়া নেয়া হয় ২৯ টাকা রেটে। প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে ঢাকা থেকে ১২৩ অ্যারোনটিক্যাল মাইল দূরে থাকা চট্টগ্রামে মানুষ বিমানে যাচ্ছে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা ভাড়ায় সেখানে মাত্র ৬১ অ্যারোনটিক্যাল মাইল দূরত্বের ঢাকা-বরিশাল রুটেও কেন একই হারে ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। একইভাবে ঢাকা থেকে ১০৬ অ্যারোনটিক্যাল দূরে থাকা সিলেট এবং ১০৫ অ্যারোনটিক্যাল মাইল দূরে থাকা রাজশাহীর সঙ্গে তুলনা করলেও ডাবল ভাড়া দিচ্ছেন বরিশালের যাত্রীরা। এমনকি সম্প্রতি চালু হওয়া সিলেট-কক্সবাজার এবং সৈয়দপুর-কক্সবাজার রুটে বিমানের নির্র্ধারণ করা ভাড়া যথাক্রমে ৪ হাজার ৮শ এবং ৫ হাজার ৯শর সঙ্গে তুলনা করলেও দেখা যায় যে ঢাকা-বরিশালের তুলনায় এ ভাড়া অনেক কম। দূরত্ব অনুপাতে ভাড়ার এ বৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা-বরিশাল রুটে বিমান পরিচালনা করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউএস-বাংলা ও নভোএয়ারের কর্মকর্তারা বলেন, ‘সমন্বয় সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে এ ভাড়া নিচ্ছি আমরা। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলা বা করার নেই। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা শুধুই বেবিচকের।’
বিমানের ভাড়া নির্ধারণে এ বৈষম্যের বিষয়ে বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট এবং বরিশাল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘বিমান চালুর শুরু থেকে এভাবে দ্বিগুণ ভাড়া আদায়ের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা অন্যায়ভাবে নেওয়া হয়েছে। ৬১ অ্যারোনটিক্যাল মাইল দূরত্বে দেড়শ মাইলের ভাড়া নিয়ে আমাদের ঠকিয়ে লাভবান হয়েছে বিমান কোম্পানিগুলো। আশা করব বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে এবং ন্যায্য ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারব আমরা।’ বেবিচকের নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণের কথা এয়ারলাইন্সগুলো জানালেও এরকম কোনো ভাড়া নির্ধারণের বিষয় অস্বীকার করেছেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘করোনা’য় দীর্ঘদিন বিমান চলাচল বন্ধ থাকার পর পুনরায় যখন এটা শুরু হয় তখন ভাড়া নিয়ে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। দু-একটি বিমান সংস্থা কম্পিটিশন প্রশ্নে নোংরা খেলা শুরু করে। তাছাড়া আমাদের বিমান বন্দরগুলোর ভাড়াও বাকি পড়তে থাকে। এই অবস্থায় যাত্রীদের হয়রানির হাত থেকে বাঁচাতে আমরা এয়ারলাইন্সগুলোকে তাদের নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়ায় যাত্রী নিতে বলি। সেটা ছিল মাথাপিছু ২ হাজার ৫শ টাকা। কোনো অবস্থায়ই সাড়ে ৩ হাজার নয়। ভাড়া নির্ধারণের এখতিয়ার বিমান সংস্থাগুলোর। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। তারপরও যখন কথা উঠেছে আমি বিষয়টি দেখব। দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলব।’ বরিশালের জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘বিষয়টি আমারও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বরিশালের মানুষ কেন অতিরিক্ত ভাড়া দেবেন? বিষয়টি সম্পর্কে বেবিচক কর্তৃপক্ষকে লিখব আমরা। প্রয়োজনে বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করব। দ্রুত যাতে দূরত্বের ভিত্তিতে ঢাকা-বরিশাল রুটের বিমান ভাড়া নির্ধারণ হয় সেই ব্যাপারে অনুরোধ জানাব সংশ্লিষ্টদের।’