সিন্ডিকেট জটিলতায় ঝুলে আছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

  • আপডেট সময় : ০৬:৪২:৪৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২২
  • / 721
প্রবাসী কণ্ঠ অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

* চুক্তির চার মাসেও কর্মী যাওয়া শুরু হয়নি * হতাশায় আগ্রহী কর্মী ও সাধারণ এজেন্সি * কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেটমুক্ত সুযোগের প্রত্যাশা

প্রবাসী কন্ঠ ডেস্ক :

দীর্ঘ তিন বছর বন্ধ থাকার পর ফের বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তির স্বাক্ষরিত হয়। এতে আগ্রহী কর্মী ও জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টদের মাঝে বেশ আশার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির চার মাস পার হলেও এখনও দেশটিতে কর্মী যাওয়া শুরু না হওয়ায় তাদের মাঝে এখন চরম হতাশা দেখা বিরাজ করছে। চুক্তির শর্তের বাইরে গিয়ে এদেশের সিন্ডিকেটকৃত ২৫টি এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিতে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে আগ্রহ দেখানো এবং তাতে বাংলাদেশ সরকার রাজি না হওয়ার কারণেই মূলত দেশটির শ্রমবাজার ঝুলে আছে বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় দেশ ও দেশের কর্মীদের স্বার্থ রক্ষা করে সিন্ডিকেটমুক্ত বৈধ সব এজেন্সির মাধ্যমেই কর্মী পাঠানোর বিষয়ে সরকারের শক্ত অবস্থান প্রত্যাশা করেছেন জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টদের বড় অংশ।

এ বিষয়ে বায়রার সাবেক নেতা ফখরুল ইসলাম গতকাল শনিবার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দেশের ৯০ শতাংশ রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক চান, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সিন্ডিকেটমুক্ত হোক। কারণ এর আগে সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে ৪ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এবার সরকার কম টাকায় কর্মী পাঠাতে চায়। এজন্য অবশ্যই সিন্ডিকেটমুক্ত হতে হবে। এটা আমাদের দেশের জন্যও আত্মসম্মানের একটি বিষয়। সিন্ডিকেট থেকে বের হয়ে এলে কর্মী পাঠানো নিয়ে কোনো জটিলতা থাকবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি ১৫ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্মী পাঠাতে প্রস্তুত। তবে মালয়েশিয়ার মাত্র ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর প্রস্তাব আমরা গ্রহণ করব না। কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া বাংলাদেশের জন্য নয়, মালয়েশিয়ার জন্য আটকে রয়েছে দাবি করে ইমরান আহমদ বলেন, আমরা আমাদের কর্মীদের সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় পাঠাতে চাই। আমরা কোনো দেশের কাছ থেকে কোনো অনৈতিক শর্ত মেনে নেব না। জানা গেছে, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর দুই দেশের মধ্যে চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষরের পর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি মালয়েশিয়ান মানব সম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান এক চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপিকে ২৫টি বাংলাদেশি রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির (বিআরএ) মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরুর আহ্বান জানান। দেশটি অবশ্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নাম প্রকাশ করেনি। এ প্রেক্ষাপটে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদ ১৮ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রীর চিঠির জবাব দেন। চিঠিতে ইমরান আহমদ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রাসঙ্গিক সনদ অনুযায়ী সর্বদা স্বচ্ছ, ন্যায্য ও নিরাপদ অভিবাসনের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন।

চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রী লিখেছেন, আমাদের প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ সমস্ত বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য সুযোগ উন্মুক্ত রেখেই গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, কম সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানো হলে তাদের মনিটরিং করা সুবিধা হয়। এজেন্সিগুলো জবাবদিহির আওতায়ও থাকে।

কিন্তু বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বলছে, ২০১৫ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে নিয়োগের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। সেই ব্যবস্থায় মাত্র ১০টি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠানোর সুযোগ পেয়েছিল। সিন্ডিকেটভুক্ত এজেন্সিগুলোর অতিলোভের কারণে ব্যবস্থাটি ভেস্তে যায়। সরকার দেশটিতে তখন কর্মী পাঠানোর খরচ মাত্র ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু সিন্ডিকেট কর্মীপ্রতি ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছিল এবং এ প্রক্রিয়ায় অনেক শ্রমিক নির্যাতন ও পাচারের শিকারও হয়েছিল।

তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল মালয়েশিয়া। তারপর অনেক দেনদরবার করে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বরে নতুন চুক্তি হয় দেশটির সঙ্গে। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে অন্তত ১২ কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়।

জানা গেছে, কিছু দিন আগেও মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস চিঠির মাধ্যমে রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাই পদ্ধতি অনলাইন ও স্বয়ংক্রিয় করা এবং দুই দেশের অনলাইন পদ্ধতি যুক্ত করা বিষয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটির (ঔডঈ) মিটিংয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কোনো জবাব মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ থেকে আসেনি।

সাধারণ এজেন্সি মালিকরা জানান, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর চিঠির জবাবে মালয়েশিয়া থেকে কোনো চিঠির জবাব না পাওয়া অথবা তার প্রস্তাব অনুযায়ী জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং করে যাবতীয় সিস্টেম ঠিক না করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণের অনুমোদন দেওয়া, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী তথা দেশের জন্য মোটেই সম্মানজনক হবে না। বরং সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর কাছে মাথানথ করা, আবারও কর্মীদের অতিরিক্ত অভিবাসনের দিকে ঠেলে দেওয়া, অনিয়ম দুর্নীতির সুযোগ দেওয়া এবং শ্রমবাজার আগের ন্যায় স্থায়িত্ব না করার ব্যবস্থা হবে, যা কারও কাম্য নয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের পাশাপাশি আরও ১৩টি দেশ থেকে কর্মী নেওয়ার চুক্তি করেছে মালয়েশিয়া। কিন্তু সেসব দেশের জন্য এজেন্সির কোনো সীমাবদ্ধতা বা সিন্ডিকেট নেই। তাই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে হলে ওইসব দেশের মতো সিস্টেমেই নিতে হবে। তাহলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বিলম্বিত হবে না, সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে।

বায়রার সাবেক নেতা ফখরুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ায় আমরা কর্মী পাঠাতে চাই, তবে সেটা যে কোনো মূল্যে নয়, আত্নমর্যাদা বিসর্জন ও দেশকে বিকিয়ে দিয়ে নয়, কিছু লোকের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যও নয় অথবা এ সেক্টরকে বিশাল দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করার জন্য ও নয়; বরং বাজার খুলতে হবে সম মর্যাদার ভিত্তিতে, যাতে অভিবাসন খরচ যেমন কম হবে, শ্রম বাজার হবে দীর্ঘায়িত।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে শনিবার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম এনডিসি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বিষয়ে নতুন কোনো খবর নেই। এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা অব্যাহত আছে।

অভিযোগে জানা গেছে, সিন্ডিকেটভুক্ত ২৫টি এজেন্সিকে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারীদের মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়েছে। তারা অনুমোদন পেলে কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে তাদের সিন্ডিকেটের খরচ উঠিয়ে নেবে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ আছে।

সূত্রমতে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন মালয়েশিয়ান নাগরিকের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ওই প্রতিষ্ঠানের একটি অনলাইন সিস্টেম বা সফটওয়্যার মালয়েশিয়া সরকার ব্যবহার হবে। এ সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রণ করার কারণেই মালয়েশিয়া সরকারকে তারা ব্যবহার করে সিন্ডিকেট করার চেষ্টায় আছে। আরেকটি সূত্র জানায়, বায়রার সাবেক কয়েকজন নেতার নেতৃত্বে এ সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হচ্ছে। এর আগেও যে সিন্ডিকেট হয়েছিল, তা তাদের নেতৃত্বেই হয়েছিল, যা ওপেন সিক্রেট। জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংখ্যা দেড় হাজার। মালয়েশিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী, এর মধ্যে মাত্র ২৫টি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দিয়ে অভিবাসন ব্যয় অনেক বাড়বে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা। ফলে কম খরচে দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না কর্মীরা।

বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সাড়ে ১০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। সূত্রমতে, বালাদেশ ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে মালয়েশিয়া থেকে ২৩৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশের জন্য নবম সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স অজর্নকারী দেশ হলো মালয়েশিয়া। তাই নতুন করে দেশটিতে আরও প্রায় ১২ লাখ কর্মী পাঠানোর যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগাতে খুব সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সুত্র : আলোকিত বাংলাদেশ

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

সিন্ডিকেট জটিলতায় ঝুলে আছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

আপডেট সময় : ০৬:৪২:৪৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২২

* চুক্তির চার মাসেও কর্মী যাওয়া শুরু হয়নি * হতাশায় আগ্রহী কর্মী ও সাধারণ এজেন্সি * কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেটমুক্ত সুযোগের প্রত্যাশা

প্রবাসী কন্ঠ ডেস্ক :

দীর্ঘ তিন বছর বন্ধ থাকার পর ফের বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তির স্বাক্ষরিত হয়। এতে আগ্রহী কর্মী ও জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টদের মাঝে বেশ আশার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির চার মাস পার হলেও এখনও দেশটিতে কর্মী যাওয়া শুরু না হওয়ায় তাদের মাঝে এখন চরম হতাশা দেখা বিরাজ করছে। চুক্তির শর্তের বাইরে গিয়ে এদেশের সিন্ডিকেটকৃত ২৫টি এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিতে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে আগ্রহ দেখানো এবং তাতে বাংলাদেশ সরকার রাজি না হওয়ার কারণেই মূলত দেশটির শ্রমবাজার ঝুলে আছে বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় দেশ ও দেশের কর্মীদের স্বার্থ রক্ষা করে সিন্ডিকেটমুক্ত বৈধ সব এজেন্সির মাধ্যমেই কর্মী পাঠানোর বিষয়ে সরকারের শক্ত অবস্থান প্রত্যাশা করেছেন জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টদের বড় অংশ।

এ বিষয়ে বায়রার সাবেক নেতা ফখরুল ইসলাম গতকাল শনিবার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দেশের ৯০ শতাংশ রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক চান, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সিন্ডিকেটমুক্ত হোক। কারণ এর আগে সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে ৪ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এবার সরকার কম টাকায় কর্মী পাঠাতে চায়। এজন্য অবশ্যই সিন্ডিকেটমুক্ত হতে হবে। এটা আমাদের দেশের জন্যও আত্মসম্মানের একটি বিষয়। সিন্ডিকেট থেকে বের হয়ে এলে কর্মী পাঠানো নিয়ে কোনো জটিলতা থাকবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি ১৫ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্মী পাঠাতে প্রস্তুত। তবে মালয়েশিয়ার মাত্র ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর প্রস্তাব আমরা গ্রহণ করব না। কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া বাংলাদেশের জন্য নয়, মালয়েশিয়ার জন্য আটকে রয়েছে দাবি করে ইমরান আহমদ বলেন, আমরা আমাদের কর্মীদের সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় পাঠাতে চাই। আমরা কোনো দেশের কাছ থেকে কোনো অনৈতিক শর্ত মেনে নেব না। জানা গেছে, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর দুই দেশের মধ্যে চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষরের পর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি মালয়েশিয়ান মানব সম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান এক চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপিকে ২৫টি বাংলাদেশি রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির (বিআরএ) মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরুর আহ্বান জানান। দেশটি অবশ্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নাম প্রকাশ করেনি। এ প্রেক্ষাপটে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদ ১৮ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রীর চিঠির জবাব দেন। চিঠিতে ইমরান আহমদ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রাসঙ্গিক সনদ অনুযায়ী সর্বদা স্বচ্ছ, ন্যায্য ও নিরাপদ অভিবাসনের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন।

চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রী লিখেছেন, আমাদের প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ সমস্ত বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য সুযোগ উন্মুক্ত রেখেই গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, কম সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানো হলে তাদের মনিটরিং করা সুবিধা হয়। এজেন্সিগুলো জবাবদিহির আওতায়ও থাকে।

কিন্তু বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বলছে, ২০১৫ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে নিয়োগের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। সেই ব্যবস্থায় মাত্র ১০টি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠানোর সুযোগ পেয়েছিল। সিন্ডিকেটভুক্ত এজেন্সিগুলোর অতিলোভের কারণে ব্যবস্থাটি ভেস্তে যায়। সরকার দেশটিতে তখন কর্মী পাঠানোর খরচ মাত্র ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু সিন্ডিকেট কর্মীপ্রতি ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছিল এবং এ প্রক্রিয়ায় অনেক শ্রমিক নির্যাতন ও পাচারের শিকারও হয়েছিল।

তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল মালয়েশিয়া। তারপর অনেক দেনদরবার করে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বরে নতুন চুক্তি হয় দেশটির সঙ্গে। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে অন্তত ১২ কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়।

জানা গেছে, কিছু দিন আগেও মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস চিঠির মাধ্যমে রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাই পদ্ধতি অনলাইন ও স্বয়ংক্রিয় করা এবং দুই দেশের অনলাইন পদ্ধতি যুক্ত করা বিষয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটির (ঔডঈ) মিটিংয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কোনো জবাব মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ থেকে আসেনি।

সাধারণ এজেন্সি মালিকরা জানান, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর চিঠির জবাবে মালয়েশিয়া থেকে কোনো চিঠির জবাব না পাওয়া অথবা তার প্রস্তাব অনুযায়ী জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং করে যাবতীয় সিস্টেম ঠিক না করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণের অনুমোদন দেওয়া, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী তথা দেশের জন্য মোটেই সম্মানজনক হবে না। বরং সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর কাছে মাথানথ করা, আবারও কর্মীদের অতিরিক্ত অভিবাসনের দিকে ঠেলে দেওয়া, অনিয়ম দুর্নীতির সুযোগ দেওয়া এবং শ্রমবাজার আগের ন্যায় স্থায়িত্ব না করার ব্যবস্থা হবে, যা কারও কাম্য নয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের পাশাপাশি আরও ১৩টি দেশ থেকে কর্মী নেওয়ার চুক্তি করেছে মালয়েশিয়া। কিন্তু সেসব দেশের জন্য এজেন্সির কোনো সীমাবদ্ধতা বা সিন্ডিকেট নেই। তাই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে হলে ওইসব দেশের মতো সিস্টেমেই নিতে হবে। তাহলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বিলম্বিত হবে না, সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে।

বায়রার সাবেক নেতা ফখরুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ায় আমরা কর্মী পাঠাতে চাই, তবে সেটা যে কোনো মূল্যে নয়, আত্নমর্যাদা বিসর্জন ও দেশকে বিকিয়ে দিয়ে নয়, কিছু লোকের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যও নয় অথবা এ সেক্টরকে বিশাল দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করার জন্য ও নয়; বরং বাজার খুলতে হবে সম মর্যাদার ভিত্তিতে, যাতে অভিবাসন খরচ যেমন কম হবে, শ্রম বাজার হবে দীর্ঘায়িত।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে শনিবার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম এনডিসি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বিষয়ে নতুন কোনো খবর নেই। এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা অব্যাহত আছে।

অভিযোগে জানা গেছে, সিন্ডিকেটভুক্ত ২৫টি এজেন্সিকে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারীদের মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়েছে। তারা অনুমোদন পেলে কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে তাদের সিন্ডিকেটের খরচ উঠিয়ে নেবে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ আছে।

সূত্রমতে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন মালয়েশিয়ান নাগরিকের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ওই প্রতিষ্ঠানের একটি অনলাইন সিস্টেম বা সফটওয়্যার মালয়েশিয়া সরকার ব্যবহার হবে। এ সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রণ করার কারণেই মালয়েশিয়া সরকারকে তারা ব্যবহার করে সিন্ডিকেট করার চেষ্টায় আছে। আরেকটি সূত্র জানায়, বায়রার সাবেক কয়েকজন নেতার নেতৃত্বে এ সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হচ্ছে। এর আগেও যে সিন্ডিকেট হয়েছিল, তা তাদের নেতৃত্বেই হয়েছিল, যা ওপেন সিক্রেট। জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংখ্যা দেড় হাজার। মালয়েশিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী, এর মধ্যে মাত্র ২৫টি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দিয়ে অভিবাসন ব্যয় অনেক বাড়বে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা। ফলে কম খরচে দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না কর্মীরা।

বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সাড়ে ১০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। সূত্রমতে, বালাদেশ ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে মালয়েশিয়া থেকে ২৩৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশের জন্য নবম সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স অজর্নকারী দেশ হলো মালয়েশিয়া। তাই নতুন করে দেশটিতে আরও প্রায় ১২ লাখ কর্মী পাঠানোর যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগাতে খুব সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সুত্র : আলোকিত বাংলাদেশ