রেমিট্যান্স কমছে, বাড়ছে সোনা
- আপডেট সময় : ০৫:০০:৫৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জুন ২০২২
- / 206
শুধু চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে শুল্ক পরিশোধ করে বৈধভাবে সোনার বার আনা গত বছরের তুলনায় সাড়ে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। এতে সরকারের রাজস্বও বেড়েছে।
চোরাচালান বন্ধ করতে সরকার শুল্ক দিয়ে সোনার বার ও স্বর্ণালংকার আনার সুযোগ দিয়েছে আগেই। উদ্দেশ্য, বৈধভাবে সোনা আমদানিতে উৎসাহ দেওয়া।
কিন্তু শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে অবৈধভাবে আনা যে পরিমাণ সোনা জব্দ করা হয়েছে তা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ সুযোগ দেওয়ার পরও অবৈধভাবে সোনা দেশে আসছে। আর যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়ছে বাস্তবে তার চেয়ে বেশি আসে বলে প্রচলিত ধারণা আছে।
এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনটি কারণ জানা গেছে। এক. বর্তমান ব্যাগেজ রুলসে আইনের অস্পষ্টতা। দুই. ডলারের দামের তারতম্যের কারণে বাড়তি মুনাফা। তিন. আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কড়াকড়ির অভাব।
এ অবস্থায় সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর বদলে ব্যাগেজ রুলস কাজে লাগিয়ে সোনা আনায় ঝুঁকছে কেউ কেউ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাগেজ রুলসে বৈধভাবে শুল্ক পরিশোধ করে এক ভরি স্বর্ণ এনে দেশে বিক্রি করলে প্রবাসীরা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মুনাফা করতে পারেন। কিন্তু বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে সেই পরিমাণ লাভ তাঁরা পান না। তাই রেমিট্যান্সের বদলে সোনার বার আমদানির প্রবণতা বাড়ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের হিসাবে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে শুল্ক পরিশোধ করে বৈধভাবে সোনার বার এসেছে ৬৩ হাজার ২৫০টি। এগুলোর ওজন সাত হাজার ৪০০ কেজি। সরকার রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ১২৭ কোটি টাকা। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মে পর্যন্ত ১১ মাসে বৈধভাবে সোনার বার এসেছে ৮৩ হাজার ৭৬০টি। এগুলোর ওজন প্রায় ৯ হাজার ৮০০ কেজি। সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের ১২ মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ১১ মাসেই আমদানি বেড়েছে সাড়ে ৩২ শতাংশ। রাজস্ব আয় বেড়েছে ৪১ কোটি টাকা।
তবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কর্মরত চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী কমিশনার নেয়ামুল ইসলাম বলেন, মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বেড়ে গেলে দেশে বৈধ ও অবৈধ দুভাবেই সোনা আসার পরিমাণ কমে যায়। যেমন আগে দিনে ৭৫০টি বার শুল্ক দিয়ে ছাড় পেয়েছে। কিন্তু গত কয়েক দিনে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিমাণ সাড়ে তিন শতে নেমেছে। অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে আবারও সোনার বার আসার পরিমাণ বেড়ে যাবে। ফলে এখানে কড়াকড়ি বা আইনি শিথিলতার বিষয় খুব একটা নেই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বৈধ পথে দুইভাবে সোনা আমদানি করা যায়। ২০১৮ সালের স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে আমদানি করতে পারে। আবার ব্যাগেজ রুলসের আওতায় সোনা ও সোনার বার শুল্ক পরিশোধ করে আনতে পারবে। ব্যাগেজ আইনে বলা আছে, একজন যাত্রী সর্বোচ্চ দুটি সোনার বার (২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি ওজন) ঘোষণা দিয়ে আনতে পারবেন। প্রতি ভরিতে দুই হাজার টাকা হিসাবে মোট ৪০ হাজার ১২৪ টাকা শুল্ক পরিশোধ করে একজন যাত্রী সোনার বার আনতে পারবেন। এর বাইরে ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার বিনা শুল্কে আনতে পারবেন, তবে সেটি ২২ ক্যারেটের হতে হবে। ২৪ ক্যারেট হলে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু ১০০ গ্রামের বেশি স্বর্ণালংকার আনলে সেটি কি শুল্ক পরিশোধ করে ছাড় হবে, নাকি অবৈধ হবে, সেটি ব্যাগেজ রুলসে স্পষ্টভাবে বলা নেই। বর্তমান ব্যাগেজ রুলসের এই দুর্বলতা অবৈধ সোনা আসার একটি কারণ। এই কারণে এই রুলসের সংশোধনের সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।
কিন্তু কাস্টমসের সহকারী কমিশনার নেয়ামুল ইসলাম বলছেন, ‘ব্যাগেজ রুলসে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালংকার আনার বিধান আছে। এর বেশি হলে তিনটি বিমানবন্দরের জন্য একটি নিয়ম প্রযোজ্য আছে, যেটা বিধানে নেই। সেটি হলো, ১০০ গ্রামের বেশি স্বর্ণালংকার আনলে প্রতি গ্রামের জন্য দুই হাজার টাকা করে শুল্ক দিতে হবে। আমরা আগে থেকেই সেই নিয়ম প্রয়োগ করে আসছি। ’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, এক লাখ টাকার রেমিট্যান্স বিদেশ থেকে প্রবাসীরা পাঠালে প্রণোদনা হিসেবে আড়াই শতাংশ অর্থাৎ আড়াই হাজার টাকা পাবেন একজন প্রবাসী। বারবার লাখ টাকার বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে কাগজপত্র জমার বাধ্যবাধকতাও তুলে দিয়েছে সরকার। মূলত প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বৈধভাবে পাঠানো উৎসাহিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়াতেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসা কমে গেছে। বিশেষ করে গত এপ্রিল থেকে রেমিট্যান্সের ধারা নিম্নমুখী। তবে রেমিট্যান্স কমার পেছনে ডলারের দাম বাড়ার কারণে হুন্ডি ব্যবসা, প্রবাসে বিদেশিদের আয় কমে যাওয়া, জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়াও অন্যতম কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে রেমিট্যান্স কমার পেছনে বৈধভাবে সোনার বার আনাকেও একটি কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কারণ এতে প্রতি ভরিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মুনাফার সুযোগ আছে।
তবে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি, চট্টগ্রামের সভাপতি মৃণাল কান্তি ধর বলেন, আজকের আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় নিয়ে বৈধভাবে শুল্ক দিয়ে একটি সোনার বার এনে বিক্রি করলে লাভ থাকবে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত হাজার টাকা। তবে বিদেশ থেকে কম দামে কেনার পরের দিনই যদি দেখা যায় দেশের বাজারে দাম বেড়েছে, তখন লাভের পরিমাণ বেশি হবে। তবে সেটা কত হবে তা বলা মুশকিল।
মৃণাল কান্তি ধর বলেন, অবৈধভাবে সোনার বার বা স্বর্ণালংকার আনার সঙ্গে কোনো জুয়েলারি ব্যবসায়ী কখনো জড়িত ছিলেন না। এসব করেন হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। এই কারণে বিমানবন্দরে অবৈধ সোনার বার আটকের পর ওই যাত্রী বা বাহকের পেছনের শক্তিকে পাওয়া যায় না। পেছনের লোকদের আইনের আওতায় আনা না গেলে চোরাচালান বন্ধ হবে না।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ