শনিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ০৬:১১ পূর্বাহ্ন
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মেয়ে সাদিয়া রহমান পপি (ছদ্মনাম) কর্মজীবীমহিলা হোস্টেল থেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।সাদিয়া রহমানের নিকটবর্তী কোনো আত্মীয় চট্টগ্রাম শহরে না থাকায় তিনি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল থেকে চাকরি করছেন।সকালের নাস্তা ও রাতের খাবার সাদিয়া এই হোস্টেলেই খেয়ে থাকেন।সাদিয়ার মতো প্রায় একশ‘র বেশি অবিবাহিত নারী কর্মজীবীরা এ হোস্টেল থেকে চাকরি করছেন।এ হোস্টেলের থেকে কেউ স্কুলে পড়ান, কেউ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, আবার কেউ বাসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দেশে বিভিন্ন জেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসকল কর্মজীবী নারীরা এই হোস্টেল থেকে চাকরি করছেন।
বাংলাদেশে আর্থিক উপার্জনমূলক খাতে নারীর পদচারণা আনুষ্ঠানিক–অনানুষ্ঠানিক উভয় কর্মক্ষেত্রেই বেড়েছে।নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহনের হার বা্ড়ায়, নারীদের আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রের পরিধি ও অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।আনুষ্ঠানিককর্মসংস্থানের আওতায় শিল্প, কলকারখানা, অফিস–আদালত, ব্যবসা–বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতেনারীরউপস্থিতিবাড়ছে।নারীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি যোগ্যতা ও দক্ষতাতেও পরিবর্তন এসেছে। সরকারি চাকরিতে কর্মকর্তা–কর্মচারির ২৭ শতাংশ নারী (সমকাল, ১৪অক্টোবর, ২০১৯)। উদ্যোক্তা হিসেবেও নারীদের উপস্থিতি নজর কেড়েছে, বিশেষত অনলাইন ব্যবসায়।করোনাকালীন সময় এই উপস্থিতির হার আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭সালের পরিসংখ্যানে দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ১ কোটি ৮৬লাখ। ২০১৩ সাথেকে২০১৭ সাল পর্যন্ত নারীর কর্মসংস্থান ৩৩.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৬.৩ শতাংশ হয়েছে। তবে নারীর অংশ গ্রহনের হার নগরের (৩০.৮) তুলনায়গ্রামীণ (৩৭.৬) এলাকায়বেশি।যদিও নগরে শিক্ষিতি নারী কর্মজীবীদের সংখ্যা বাড়ছে।নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি,যা নারীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব।নারীর ক্ষমতায়নের নারীর যোগ্যতা, দক্ষতা, মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে। তবে অর্জিত যোগ্যতা, দক্ষতাও মানসিক শক্তি কাজে লাগানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করাও অত্যাবশ্যক সমাজে ও পরিবারে।
গ্লোবাল জেন্ডারগ্যাপ (বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য)-২০২০এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারী পুরুষের সমতার দিক দিয়ে১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে ৫০তম।২০১৭ ও ২০১৮সালে এ অবস্থান যথাক্রমে ৪৭তম ও ৪৮তম, এবং২০০৬সালে এই অবস্থান ছিলো ৯১তম।তবে নারী পুরুষের সমতা বিবেচনায় নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও সুযোগে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৩টি দেশের মধ্যে ১৪১তম।গত কয়েক দশকে নারীর ক্ষমতায়নের সার্বিক অবস্থানের পরিবর্তন হলেও সে অনুযায়ী নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহনের হারে পিছিয়ে আছে।এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো কর্মজীবী নারীর নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা।
বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নের পেছনে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা কর্মজীবী নারীর নিরাপদ আবাসন সংকট।গত তিন দশকে নারীর ক্ষমতায়ন হলেও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পেছনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে কর্মজীবী নারীর নিরাপত্তা।এ ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা নারীর আবাসন সমস্যা।রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহর এলাকায় কর্মজীবী অবিবাহিত নারীদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা।নারীরা শিক্ষাজীবন পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হোস্টেলে থেকে নিরাপদে সম্পন্ন করতে পারলেও কর্মজীবনে অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে আবাসন ব্যবস্থা একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়ায়।এখন অনেক নারীকে বলতে শোনা যায় শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরি পাওয়ার চেয়েও কঠিনএকটি বাসা পাওয়া।কর্মজীবী নারীদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায়না।পরিবারপরিজন ছাড়া বলতে গেলে বাসা ভাড়া পাওয়া যায়ই না, বা পাওয়া একেবারেই কঠিন।
দেশে কর্মসংস্থানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা ও এগিয়ে আসছেন।পুরুষের পাশাপাশি নারীকে ও কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে হচ্ছে।শহরে এসে কর্মজীবী নারীরা ইচ্ছা করলেও শহরে যে কোনো স্থানে নিরাপদ আবাসন সুবিধা পায়না, পুরুষের মতো করে।বিশেষ করে অবিবাহিত কর্মজীবী নারীদের শহর এলাকায় আবাসন সমস্যা অনেক বেশি প্রকট।ব্যাচেলার কর্মজীবী পুরুষের অনেক ক্ষেত্রে আবাসন সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলেও অবিবাহিত নারীর পক্ষেতা সম্ভব হয়ে ওঠে না।কুসংস্কার, লিঙ্গ বৈষম্যসহ নানা প্রতিবন্ধকতা জন্য দায়ী।কয়েকজন ব্যাচেলার পুরুষ মিলে একটি বাড়ি ভাড়া করে মেসে থাকার সুযোগ পেলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সহজেই নারীরাই এ সুযোগ পান না।নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থানা থাকায়, অবিবাহিত নারীদের মধ্যে কর্মসংস্থানের আগ্রহ হারাচ্ছে, এমনকি অনেকে কর্মসংস্থান শুরু করেও নিরাপদ আবাসন সংকটে তা ছেড়ে দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম অধিক জনসংখ্যার একটি দেশ যেখানে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসনের হার দ্রুত বাড়ছে।একইভাবে শিল্পায়নের জন্য নগরায়ন ও দ্রুত বেড়ে চলছে। মানুষের চাহিদার পাশাপাশি জীবন যাত্রার মান বেড়েছে।আজ প্রয়োজনের তাগিদে নারীরা ঘর থেকে বের হয়েছে।বিভিন্নকল–কারখানা অফিস–আদালতে নারীর একটি বিশাল অংশ তাদের নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে নিতে সহায়তা করেছে। কর্মজীবী নারীদের আবাসন সুবিধা ও সেবা প্রদানের লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণায়ের অধীন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সারাদেশে কর্মজীবী নারীদের আবাসন ব্যবস্থা কার্যক্রম (মহিলা হোস্টেল) পরিচালনা করছে।এ সকল হোস্টেলে কর্মজীবি নারীদের স্বল্পমূল্যে ও নিরাপদ আবাসন সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে।নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মজীবী নারীদের আবাসন সংকটের কথা বিবেচনা করে সরকার রাজধানী ঢাকা শহরে সরকারি খরচে তিনটি এবং খুলনা–যশোর রাজশাহী ও চট্টগ্রামে একটি করে হোস্টেল স্ব–অর্থায়নে পরিচালনা করছে হচ্ছে, যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় এখনো অপ্রতুল।এসকল কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে প্রায় চৌদ্দশত সিট সংখ্যা রয়েছে।
বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে নারীর কর্মসংস্থানের অন্যতম খাত তৈরি পোশাক শিল্প।দেশে তৈরি পোশাক শিল্পখাতে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে।এ শিল্পে কর্মরত কর্মজীবী নারীদের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা লক্ষ্যে করার সরকার ঢাকা জেলার সাভারের আশুলিয়াতে ১২তলা ভবন তৈরি করেছে।এই গার্মেন্টস কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে ৭২০জনের নারীর আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে।গার্মেন্টস কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলটি অত্যাধুনিক এবং এতে লিফটের ব্যবস্থাও রয়েছে।এই কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলটি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে একটি প্রকল্পে আওতাধীন।
১৮–৩৫বছরেরসুবিধাবঞ্চিত অদক্ষ নারীদের নিরাপদ আবাসন প্রদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ সেবা প্রদান করে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা এবং জীবনমান উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর।একার্যক্রমের আওতায় নোয়াখালী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জও পিরোজপুর জেলার যথাক্রমে সোনাইমুড়ী, কালিগঞ্জ, আড়াইহাজার ও মঠবাড়িয়া উপজেলায় ট্রেনিং সেন্টার চারটি কেন্দ্রের ছয়তলা ভিতের উপর তিন তলায় ৫০আসন বিশিষ্ট চারটি কর্মজীবী হোস্টেল ভবন নির্মাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।এছাড়া নালিতা বাড়ী উপজেলায় কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল কাম ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।এ প্রকল্পে প্রশিক্ষণগ্রহণের মাধ্যমে প্রান্তিক সুবিধা বঞ্চিত ও অনগ্রসরনারীরাদারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঝুঁকি হ্রাসকরণসহ এ অঞ্চলের কর্মজীবী নারীদের প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করছে।এবং কারিগরিও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষনের মাধ্যমে নারীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা ওএ প্রকল্পের লক্ষ্য।এই কার্যক্রমের আওতায় ৬০জনের আবাসন সুবিধা প্রদানসহ৬ তলা ভিতের উপরে ছয় তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
পল্লী ও শহর এলাকায় গৃহায়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ব্যবস্থায় নারী প্রেক্ষিত অন্তর্ভুক্ত করা; একক নারী, নারী প্রধান পরিবার, শ্রমজীবীও পেশাজীবী, নারী শিক্ষানবিস ও প্রশিক্ষনার্থী নারীর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা গৃহ ও আবাসন সুবিধা প্রদানেরওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা; এবং নারীর জন্য বিশেষ সুবিধা যেমন– হোস্টেল, ডরমেটরি, বয়স্কদের হোম, স্বল্পকালীন আবাসস্থলের ব্যবস্থা করা এবং গৃহায়ণ ও নগরায়ন পরিকল্পনায় দরিদ্র, দুস্থওশ্রমজীবী নারীর জন্য সংরক্ষিত ব্যবস্থা করার মতো বিষয়গুলি জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি–২০১১এর, ৩৫ধারায় গৃহায়ন ও আশ্রয় সম্পর্কে বলা হয়েছে।
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি–২০১১ বাস্তবায়নকল্পে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।এই জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে ষষ্ঠ পঞ্চ বার্ষিকীপরিকল্পনা (২০১১–২০১৫) ও জাতীয় গৃহায়ণনীতি– ১৯৯৩ এর আলোকে বর্তমান কার্যক্রম চলমান রয়েছে।বর্তমান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, আশ্রয়ণ–২ প্রকল্পযার আওতায় রয়েছে– দরিদ্রনারীদের স্বল্প ব্যয়ে ঘর নির্মাণ করে দেয়া; ভাসমান ও বস্তিতে বসবাসকারীপরিবারের জন্য স্বল্প মূল্যে বহুতল ভবন নির্মাণ করা; এবংদুর্যোগ প্রবণ এলাকায় নারীদেরকে গৃহ নির্মাণ ঋণ কর্মসূচি।অন্য দিকে একক নারী, নারী প্রধান পরিবার, শ্রমজীবীও পেশাজীবীনারী, শিক্ষানবিশ ও প্রশিক্ষণার্থী নারীদের নিরাপদ গৃহ ও আবাসন সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার নিম্নবিত্ত এবং মধ্য বিত্ত শ্রেণি কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের জন্য দিবা–যত্ন কর্মসূচি এবং শ্রমজীবী কর্মজীবী নারীদের জন্য ডরমেটরি, নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।এছাড়াও নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা যেমন হোস্টেল, ডরমেটরি, বয়স্কদের হোম, স্বল্পকালীন আবাসস্থলের ব্যবস্থা করা এবং গৃহায়ণ ও নগরায়ন পরিকল্পনায় দরিদ্র, দুস্থও শ্রমজীবী নারীদের জন্য সংরক্ষিত ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে ডরমেটরি বরাদ্দের জন্য বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই (এসডিজি–৫) জেন্ডার সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন অর্জনে সাফল্য দেখাতে হবে।সে জন্য আর্থ–সামাজিক, আইনগত, রাজতৈনিকসহ সবক্ষেত্রে নারীর প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল পরিবেশে পরিণত করতে হবে।আর তার জন্য কর্মজীবী নারীদের নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।এ লক্ষ্যে সরকার তার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর/সংস্থার মাধ্যমে যেসকল কার্যক্রম, কর্মসূচি এবং প্রকল্প গ্রহণ করেছে তার যথাযথ বাস্থবায়ন কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে।
মোঃ জাহাঙ্গীর আলম
তথ্য অফিসার
তথ্য অধিদফতর